ভারে যেন ছিঁড়ে পড়তে না পারে সেজন্য নেটের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রতিটি তরমুজ। পানির ওপর সবুজ ডগায় ঝুলে থাকা রসালো তরমুজ দেখে যে কারোরই মন ভরে যাবে। রসালো প্রতিটি তরমুজের ওজন ৫ থেকে ৮ কেজি।
এমনটাই দেখা গেছে খুলনার ডুমুরিয়া বাগারদাইড় গ্রামের কৃষক মিলটন রায় ও বিশ্বজিৎ রায়ের ঘেরের পাড়ে আইলে।
শুধু তাদেরই নয় বাঁশ ও নাইলনের সূতা দিয়ে তৈরি মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের এ দৃশ্য এখন খুলনাঞ্চলে বেশ পরিচিত। জেলার বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, বাগেরহাট সদর মোল্লাহাট ও পাশ্ববর্তী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়ও এভাবে চাষ হচ্ছে স্বাদের তরমুজ।
এই এলাকার বিভিন্ন ঘেরে চাষ করা হয়েছে মাছ। আর ঘেরের পতিত আইলের নোনা মাটিতে তরমুজ চাষ করে ভাগ্য বদল করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। এবার নোনা মাটিতে অসময়ের বর্ষাকালীন তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি কেজি তরমুজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। ভালো দাম পেয়ে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট গ্রীষ্মকালীন তরমুজের পাশাপাশি বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গত বছর খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার তিন কৃষক প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে তরমুজ চাষ করে সফলতা অর্জন করেন। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো চাষ করা হচ্ছে অসময়ের বর্ষাকালীন তরমুজ। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বেড়েছে কৃষকের সংখ্যাও।
সূত্রটি আরও জানায়, চলতি বছর ১৫ কৃষক ৪৯৫ শতক জমিতে বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করেছেন। এর মধ্যে খুলনার ডুমুরিয়া-চাঁদগড় গ্রামে ৪টি, বটিয়াঘাটার বয়ারভাংগা গ্রামে ৫টি, গোপালগঞ্জ সদরে ৪টি এবং বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় ২টি করে মোট ১৫টি গবেষণা প্লট স্থাপন করা হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, গত ১ জুন বর্ষাকালীন তরমুজের বীজ বপন করা হয়। যা ১৩ আগস্ট থেকে কাটা শুরু করেছেন তারা। প্রথম পর্যায়ে তরমুজ কাটা শেষ হলে তারা দ্বিতীয়বার বীজ বপন করবেন। শীত পড়লে আবার ফল কাটা হবে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি, সার ও পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি। এ প্রকল্প লবণাক্ত এলাকায় ঘেরের পাশে পতিত জমিতে অসময়ের বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করার জন্য কৃষককে উদ্ধুদ্ধ করে। মাটি ও পানি পরীক্ষা করে এ তরমুজের চাষ করা হয়। এবার হাইব্রিড নাম্বার ওয়ান ও টপ সুইট নামের তরমুজের দুটি জাত চাষ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অংগ) আমন ধান কাটার পর পতিত জমিতে লবণাক্ত এলাকায় তরমুজ ও ভূট্টা চাষ করার জন্য কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করা হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ, কীটনাশক, সার, বীজ ও মাচা তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, নগদ অর্থ এবং মাস্ক বিতরণ করা হয়।
ডুমুরিয়ার বাগাড়দাইড় গ্রামের চাষি মিলটন রায় ও বিশ্বজিৎ রায় জানান, তারা প্রথমবার চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে। ভালো দামে বিক্রি করছেন। চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন। যথাযথ প্রশিক্ষণ, মাটি ও সার ব্যবস্থাপনার ফলে এ প্রকল্পের তরমুজ বাম্পার ফলন সম্ভব হয়েছে।
তরমুজ চাষ করতে তাদের খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকা। বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ করে ৪ লাখ টাকা।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এসআরডিআইয়ের পরিচালক শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস জানান, ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষ করায় বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন হয় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পাওয়া যায়। এতে করে কৃষকরা আইপিএম (ওষুধ ব্যবহার না করে) পদ্ধতিতে ফসল আবাদ করছেন। ফলে পোকা মাকড়ের আক্রমণও কম হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বর্ষাকালীন তরমুজ, শিম, টমোটো, হলুদ, মানকচু, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও ধানের ওপর গবেষণা চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দক্ষিণের লবণাক্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।